খেলার মাঠে সবার আগে
Nsports-logo

শুক্রবার, ২রা মে ২০২৫

দশ জেলার খেলার দায়িত্বে নয় জন নারী

খেলোয়াড়, কোচ, সংগঠক, বিচারকের বৃত্তেই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আলোচনা ঘুরপাক খায়। এর বাইরে কখনো কখনো হয়তোবা চিকিৎসক, পৃষ্ঠপোষক বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা এই তালিকায় যুক্ত হন। আলোচনার বাইরেই থাকেন জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তারা। অথচ একটি জেলার খেলা-ধূলার সামগ্রিক দায়িত্বে থাকেন তারাই। ৬৪ জেলার মধ্যে এখন দশটি জেলায় নয় জন নারী ক্রীড়া কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ক্রীড়া পরিদপ্তর। সেই পরিদপ্তরের অধীনে ৬৪ জেলায় রয়েছে জেলা ক্রীড়া অফিস। সেই অফিসের প্রধান একজন ক্রীড়া কর্মকর্তা। পরিদপ্তর মূলত জেলা পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খেলাধূলা নিয়ে কাজ করে। কিন্তু ক্রীড়া কর্মকর্তাকে পরিদপ্তরের নির্দিষ্ট কাজের বাইরে জেলা ক্রীড়া সংস্থা, জেলা প্রশাসন ও জেলায় অনুষ্ঠিত সরকারের সকল খেলার সঙ্গেই সম্পৃক্ত থেকে কাজ করতে হয়।

১৯৭৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ক্রীড়া পরিদপ্তরের জন্ম। লোভন, তারিকউজ্জামান নান্নু, হোসেন ইমাম চৌধুরি শান্টাসহ আরো অনেক সাবেক ক্রীড়াবিদ অবসরের পর পরিদপ্তরে ক্রীড়া অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন। ৪০ বছর পর ২০১৬ সালে প্রথম নারী ক্রীড়া কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন ফারজানা আক্তার সাথী। এরপর ২০১৯ সালে এক যোগে আট জন নারী এই পদে আসেন। পরিদপ্তরে এখন ৫২ জন অফিসারের মধ্যে ৯ জন নারী।

একজন নারী জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, বিচারক হলে দেশ জুড়ে আলোড়ন উঠে। অথচ একজন নারী ক্রীড়া কর্মকর্তা হিসেবে পুরো জেলায় কাজ করলেও সেটা খোদ ক্রীড়াঙ্গনেই আলোচিত হয় না। এ নিয়ে দেশের প্রথম নারী ক্রীড়া কর্মকর্তা ফারজানা সাথীর মন্তব্য,

‘একটি জেলায় যে কোনো খেলায় ক্রীড়া অফিসারের সম্পৃক্ততা থাকেই। বাস্তবিক অর্থে, ক্রীড়া অফিসার ছাড়া জেলা পর্যায়ে কোনো খেলা হয় না বললেই চলে। এরপরও আমরা ফোকাসড নই। আমাদের পরিদপ্তরের আরো মান্নোয়ন ও জেলা ক্রীড়া অফিসগুলোর সাংগঠনিক ব্যপ্তি হলে তখন হয়তো এটা হতে পারে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাথী হ্যান্ডবল খেলেছেন। খেলাধূলায় আসা অনেকেই পরবর্তীতে কোচ, সংগঠক, রেফারি/আম্পায়ার হন। ক্রীড়া অফিসার হওয়ার ইচ্ছে সাধারণত সবার থাকে না। বিশেষত ২০১৬ সালের আগে কোনো নারী এই পথে হাটেননি।

এই পেশা বেছে নেয়ার কারণ সম্পর্কে সাথী বলেন,

‘আমি ছোটবেলা থেকেই খেলাধূলা করেছি। ইচ্ছে ছিল এতেই ক্যারিয়ার করার। ক্রীড়া অফিসার প্রথম শ্রেণীর জব। পাশাপাশি একটু ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে এতে কাজ শুরু করি।’

জাতীয় বা ক্রীড়াঙ্গনে প্রথমের একটা বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। সাথী প্রথম নারী ক্রীড়া অফিসার হলেও সেভাবে এখনো তেমন কোনো স্বীকৃতি পাননি। তবে এ নিয়ে তার তেমন আক্ষেপ নেই,

‘২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমি একাই ছিলাম নারী ক্রীড়া অফিসার। এটা আমার জন্য অবশ্যই গর্বের আমিই প্রথম নারী ক্রীড়া অফিসার। এখনো সেভাবে এটি স্বীকৃতি বা আলোচনায় না আসলেও আশা করি এক দিন না এক দিন হবে।

তবে আমার সহকর্মীরা শুরু থেকে উৎসাহ জুগিয়েছে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে এক ঝাক নারী এই পেশায় আসার পর তারাও আমাকে অনেক সম্মান করে। এটাই তো বড় পাওয়া।’

৯ নারী জেলা ক্রীড়া অফিসারের মধ্যে খাদিজা পারভীন ও মাহমুদা আক্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ফেরদৌসী আক্তার বন্যা জাহাঙ্গীরনগর, আফরিন আক্তার মনি ও সেতু আক্তার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ফারজানা আক্তার সাথী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, হীরা আক্তার ও অনামিকা দাস জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ফারজানা আক্তার মুমু একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন।

৯ জনের মধ্যে সাত-আট জনই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এবং বিভিন্ন খেলায় জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করতেন নিয়মিত। খেলাধূলা-পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রীড়া অফিসার হতে সবাইকে বিপিএড (শারীরিক শিক্ষার উপর বিশেষায়িত ডিগ্রি) ডিগ্রি নিতে হয়েছে। উচ্চ শিক্ষিত হয়েও তারা এই পেশায় এসেছেন খেলার টানেই।

‘আমি নিজে খেলোয়াড় ছিলাম। আমি চাই আমার মাধ্যমে আরো খেলোয়াড় বেরিয়ে আসুক’।

-বলেন জামালপুরের জেলা ক্রীড়া অফিসার আফরিন আক্তার মনি।

ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলাধূলার পরিবেশ ও ঐহিত্য অনেক পুরোনো। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও এই পেশায় আগমন নিয়ে নরসিংদী জেলার ক্রীড়া কর্রমকর্তা ফারজানা আক্তার মুমু বলেন,

‘খেলাধূলা ছোটবেলা থেকে পছন্দ। পারিবারিক কারণে বিবিএ নিয়ে পড়লেও আমার ইচ্ছে ছিল খেলায় ক্যারিয়ার গড়ার। তাই একাডেমিক পড়াশোনার জন্য বিপিএড পরীক্ষা দেই। সেখানে উত্তীর্ণ হয়ে ক্রীড়া অফিসার হিসেবে কাজ করি।’

সরকারি অনেক চাকরির মতো ক্রীড়া কর্রমকর্তা বদলির চাকরি। সাধারণত ২-৩ বছর পর এক জেলা থেকে আরেক জেলায় বদল হয়। আবার কখনো এক বছরের মধ্যেও একাধিক বদলির ঘটনা ঘটে। নারী হয়ে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেয়া আবার পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব বাড়া উভয় চ্যালেঞ্জ। এটা স্বাভাবিক ভেবেই ক্রীড়া অফিসাররা কাজ করছেন।

‘অন্য সব সরকারি চাকরির মতোই আমাদের এই চাকরি। এটা মেনেই আমরা কাজ করছি। অনেক সময় অনেকের স্বামী-স্ত্রীর পোস্টিং দুরের দুই জেলায় হয়। তখন তো একটু সমস্যা হয়ই। পরিবারও আমাদের যথেষ্ট সহায়তা করে। এই চ্যালেঞ্জ উতরেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি’।

-বলেন মানিকগঞ্জের ক্রীড়া অফিসার ফেরদৌসী আক্তার বন্যা।

প্রতি জেলায় এক জন ক্রীড়া অফিসার থাকার কথা। নিয়োগের দীর্ঘসূত্রিতা, সিনিয়রদের অবসর মিলিয়ে এক অফিসার আবার একাধিক জেলাও সামলাতে হয়। জেলা ৬৪ , অফিসার ৫২ জন। তাই কয়েকজনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে একটির বেশি জেলার দায়িত্ব পালন করতে হয়।

নারীদেরও অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে একাধিক জেলা সামলানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। বর্তমানে ফারজানা আক্তার সাথী গাজীপুরের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের ক্রীড়া অফিসারের ভূমিকায় রয়েছেন। একাই দুই জেলা সামলানো নিয়ে তিনি বলেন,

‘এটাই অবশ্যই কঠিন। সপ্তাহে একাধিকবার দুই জেলায় যাতায়াত করতে হয়। এরপরও আমাদের অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। আমরা দুই জেলাতেই সমানভাবে কাজ করার চেষ্টা করি।’

জেলার মধ্যেই অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েই কাজ করতে হয় ক্রীড়া অফিসারদের। কিছু সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে ফেরদৌসী আক্তার বন্যা বলেন,

‘জেলা ক্রীড়া অফিস প্রায় জায়গায় ভাড়া বাসায়। এর পাশাপাশি লোকবল সংকটও রয়েছে। অনেক জেলায় ক্রীড়া অফিসারকে একাই কাজ করতে হয়। অফিস সহকারীও অনেক সময় থাকে না। আবার থাকলেও কাজের পরিসরে সেটা অপ্রতুল। খেলাধূলা-আয়োজনে সরঞ্জাম প্রয়োজন।

সেই সরঞ্জাম বহনের জন্য জেলা ক্রীড়া অফিসার গাড়িও পান না। অনেক জেলা থাকে বড় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত খেলা আয়োজনে ছুটে চলতে হয় কখনো বাইকে কখনো অন্য কোনো মাধ্যমে। সকল পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা নারীরা কাজ করে যাচ্ছি।’

কোচরা খেলোয়াড়দের খেলা শেখান। সংগঠকরা খেলাধূলা আয়োজন করেন। ক্রীড়া অফিসরাকে খেলাধূলার মৌলিক জ্ঞান, সাংগঠনিক দক্ষতার পাশাপাশি সরকারের অর্থ ব্যয়ের নিয়মও জানতে হয়। ক্রীড়া অফিসার হিসেবে কাজের ক্ষেত্রে নারীরা বেশ পেশাদার।

‘আমরা নারী ক্রীড়া অফিসার যারা রয়েছি কাজে শতভাগ পরিপূর্ণই করি। ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট কেউ বলতে পারবে না যে পুরুষ অফিসার থাকলে কাজটি হতো বা নারী অফিসার থাকায় হয়নি’।

-বলেন মুন্সিগঞ্জের নারী ক্রীড়া অফিসার খাদিজা পারভীন।

জেলা ক্রীড়া অফিসার পদাধিকার বলে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য। ৫ আগস্টের পর ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সকল জেলা-বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা ভেঙে দিয়েছে। এখন ক্রীড়া অফিসাররা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। উভয় দায়িত্ব নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় তাদের।

‘পরিদপ্তরের মাধ্যমে জেলা ক্রীড়া অফিসের হয়ে নিজস্ব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে তো হয়ই। এখন জেলা ক্রীড়া সংস্থার দায়িত্ব পেয়ে ক্রীড়া তারুণ্যের উৎসবে আমরা সক্রিয়ভাবে পালন করেছি। দু’টি সংস্থা চালানো অবশ্যই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা নারীরা এই চ্যালেঞ্জ ভালোভাবেই নিয়েছি’।

-বলেন ফেনী জেলা ক্রীড়া অফিসার ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য সচিব হীরা আক্তার।

৯ নারী অফিসার যে জেলাগুলোর দায়িত্বে-

আফরিন আক্তার মনি (জামালপুর), ফেরদৌসী আক্তার বন্যা (মানিকগঞ্জ), খাদিজা পারভীন (মুন্সিগঞ্জ), অনামিকা দাস (মাগুরা), সেতু আক্তার (নেত্রকোণা), ফারজানা আক্তার সাথী (গাজীপুর, অতিরিক্ত দায়িত্ব নারায়ণগঞ্জ), ফারজিন আক্তার মুমু (নরসিংদী), হীরা আক্তার (ফেনী) মাহমুদা আক্তার (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Privacy & Cookies Policy