ম্যাচের দ্বাদশ ওভারে বল হাতে আক্রমণে এলেন হার্দিক পান্ডিয়া। রোহিত শার্মা তখন মাঠেই নেই। কিন্তু ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে গর্জন উঠল, “রোহিত… রোহিত…।” পরে ম্যাচের দ্বিতীয় ভাগে যখন ‘ইম্প্যাক্ট প্লেয়ার’ হিসেবে ব্যাটিংয়ে নামলেন রোহিত, দর্শকের উন্মাদনা তখন তুঙ্গে। ৩৮ বলে ৬৮ রানের ইনিংস খেলে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানও মাতিয়ে রাখলেন গোটা স্টেডিয়াম।
তিনি আউট হতেই এক মুহূর্তের নীরবতা। পরমুহূর্তেই আবার তুমুল হর্ষধ্বনিতে রোহিতকে বিদায় জানালেন দর্শকেরা। কে জানে, মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের জার্সিতে তাকে আবার দেখা যাবেকি না! রোহিতের জায়গায় যখন নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে গেলেন হার্দিক পান্ডিয়া, তখন বদলে গেল গ্যালারির সুর। এবার ভেসে এলো ‘দুয়ো।’ সেই ‘দুয়ো’ চলতে থাকল ক্রমাগত।
ম্যাচ শেষে একটি দুঃসংবাদও শুনতে হলো পান্ডিয়াকে। মন্থর ওভাররেটের জন্য ৩০ লাখ রুপি জরিমানা তো হয়েছেই, পাশাপাশি মুম্বাই অধিনায়ক নিষিদ্ধও হয়েছেন এক ম্যাচ।
লাক্ষ্নৌ সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে শুক্রবারের ম্যাচটি ছিল এই মৌসুমে মুম্বাইয়ের শেষ ম্যাচ। পান্ডিয়ার নিষেধাজ্ঞা তাই কার্যকর হবে পরের মৌসুমে। তিনি যদি দল বদলে অন্য কোনো দলে যান, নতুন দলের হয়েই কার্যকর হবে তার এই সাজা।
অধিনায়কের পাশাপাশি আর্থিক জরিমানা গুনতে হবে তার সতীর্থদেরও। ‘ইম্প্যাক্ট প্লেয়ারসহ’ দলের বাকি ১১ জনের জরিমানা ১২ লাখ রুপি বা ম্যাচ ফির অর্ধেক, পরিমাণে যেটি কম আসে।
এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞার চেয়েও বড় সংকট অবশ্য পান্ডিয়ার সামনে আছে। পরের আইপিএলেও কি তিনি মুম্বাইয়ের অধিনায়ক থাকবেন বা তাকে রাখা হবে? দলে কি থাকবেন নাকি বেছে নিতেহবে নতুন ঠিকানা? প্রশ্ন অনেক।
শেষ ম্যাচে যে অভিজ্ঞতা তার হয়েছে, তা নতুন কিছু নয়। মৌসুমের শুরু থেকেই তিনি বোলিং বা ব্যাটিংয়ে এলেই ‘দুয়ো’ দেওয়া হয়েছে তাকে কিংবা ‘রোহিত… রোহিত’ স্লোগান দেওয়া হয়েছে তাকে উদ্দেশ্য করে। মৌসুমজুড়েই এটা চলেছে।
মৌসুম শুরুর আগে গুজরাট টাইটান্স থেকে পান্ডিয়ার মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সে নাম লেখানো তুমুল আলোড়ন তুলেছিল ভারতীয় ক্রিকেটে। এরপর যথন নাটকীয়ভাবে রোহিতকে সরিয়ে পান্ডিয়াকে অধিনায়ক করা হলো, তখন তা জন্ম দিল নতুন এক মাত্রার। আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তো উঠলই, পাঁচটি আইপিএল শিরোপাজয়ী জনপ্রিয় অধিনায়ককে এভাবে সরিয়ে দেওয়া যে সমর্থকেরা ভালোভাবে নেয়নি, তা স্পষ্ট হতে থাকে ক্রমেই। শুরু থেকেই দর্শকদের তোপের মুখে পড়তে হয় পান্ডিয়াকে।
এমন প্রবল চাপের মুখে পান্ডিয়া নিজেকে একরকম হারিয়েই ফেলেন। গোটা মৌসুমে একটি ফিফটিও তিনি করতে পারেননি। ১৩ ইনিংসে মোট ২১৬ রান করেন কেবল ১৮ গড়ে। ওভারপ্রতি ১০.৭৫ রান দিয়ে উইকেট নিতে পারেন ১১টি।
দলের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নরা ১৪ ম্যাচের স্রেফ চারটি জিতে মৌসুম শেষ করেছে ১০ দলের মধ্যে সবচেয়ে তলানিতে থেকে।
সব মিলিয়ে মৌসুমটা যে হতাশার, তা অকপটেই মেনে নিলেন মুম্বাইয়ের কোচ মার্ক বাউচার। পান্ডিয়ার জন্য সহানুভূতিও শোনা গেল দক্ষিণ আফ্রিকার এই কিংবদন্তি কিপারের কণ্ঠে।
“এরকম দুয়ো শোনা খুব ভালো কিছু নয় অবশ্যই। হার্দিকের জন্য আমার খারাপও লেগেছে। এই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া ভালো কিছু নয়। হ্যাঁ, কিছু ব্যাপার আমাদেরকে অবশ্যই ঠিকঠাক করতে হবে এবং আমরা তা করব।”
“তবে এখন সেসবের জন্য সঠিক সময় নয়। সবাই খুব হতাশ এবং আবেগপ্রবণ অবস্থায় আছে। কাজেই নিকটতম কোনো সময়ে খুব ভালো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। পরে সময়মতো ভাবতে হবে আমাদের, খতিয়ে দেখত হবে আসলেই কী হয়েছে।”
মাঠের বাইরের সমালোচনা, সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের আলোচনা ও মাঠের দর্শকদের আচরণ, সবকিছুকে এমনিতে খুব একটা পাত্তা দিতে চাননি পান্ডিয়া। তবে সেসব যে তার পারফলম্যান্সে প্রভাব ফেলেছে, তা মেনে নিলেন মুম্বাইয়ের কোচ।
“হার্দিক এখানে থাকলে সে নিজেও বলত যে নিজের পারফরম্যান্সে সে হতাশ। অধিনায়কত্বের দিক থেকে, কয়েকটি ম্যাচে সে ভালো করেছে। তার আশেপাশে এত কিছু হয়েছে যে, সেসব তার চিন্তাভাবনাকে নানা সময়ে প্রভাবিত করেছে। যেটা আমি বলেছি, অধিনায়ক হিসেবে এসব তার জন্য কঠিন।”
“আমাদের ড্রেসিং রুমের ভেতর নিশ্চিতভাবেই অনেক সহায়তা সে পেয়েছে। তবে খেলোয়াড় হিসেবে এরকম সময় সবার জন্যই কঠিন। তার জন্য সবার সহানুভূতিও আছে। অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে, ডা অনাকাঙ্ক্ষিত।”
বাউচার অবশ্য পান্ডিয়ার নেতৃত্বের সামর্থ্যে আস্থা হারাচ্ছেন না। এই অলরাউন্ডারের নেতৃত্বে গত দুই মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ হয়েছে গুজরাট টাইটান্স। এবার মুম্বাইয়ের অভিজ্ঞতায় নেতা হিসেবে পান্ডিয়া আরও পোক্ত হয়ে উঠবেন বলে মনে করেন কোচ।
“অবশ্যই হার্দিক এসব থেকে শিখবে এবং নেতৃত্বে নিজেকে গড়ে তুলবে আরও। সময় যদিও এখন কঠিন, কিন্তু তা পেরিয়ে যাবে এবং তাকে আরও কঠিন নেতা করে তুলবে এবং সে অবশ্যই এতে আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। আমি এখনও মনে করি, অধিনায়ক হিসেবে হার্দিক পান্ডিয়ার কাছ থেকে দারুণ অনেক কিছু আসবে।”
রোহিত শার্মার ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন ছুটে গেল বাউচারের দিকে। মুম্বাই কোচ সবকিছু ছেড়ে দিলেন সময়ের হাতে।
“সত্যি বলতে, রোহিতের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। গতকাল বা পরশু রাতে তার সঙ্গে কথা হয়েছে আমার, মূলত তা ছিল গোটা মৌসুমের ছোট্ট পর্যালোচনা। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘হোয়াট নেক্সট ফর রোহিত শার্মা?’ সে বলল, ‘বিশ্বকাপ।’ এটিই নিখুঁত উত্তর। রোহিতের ভবিষ্যৎ নিয়ে এটিই জানার ছিল আমার।”
“আমার মতে, তার ভাগ্য নিজের হাতেই। সামনের মৌসুমের আগ বড় নিলাম আছে। কে জানে, কী হবে! একেকটি দিন ধরে এগোতে হবে আমাদের।”