ইন্টারকে গোলের লজ্জায় ডুবিয়ে প্রথমবার ইউরোপসেরার মুকুট পিএসজির
ইন্টার মিলান ০-৫ পিএসজি
১৯৯৩ সালে এই মিউনিখ শহরেই অলিম্পিক মার্শেই জিতেছিল চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা। অনেকগুলো বছর পর ২০২৫ সালে এসে আরও একবার ফ্রান্সের একটা দল মিউনিখ থেকেই বুঝে পেলো চ্যাম্পিয়নস লিগের বিজয়ীর খেতাব।
ইন্টার মিলানকে একপ্রকার বিধ্বস্ত করে প্রথমবার ইউরোপসেরার মুকুট নিয়ে গেল পিএসজি।
১৪ বছর আগে কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপ পিএসজি কেনার পর রোপন করা হয়েছিল স্বপ্নের বীজ। সেই স্বপ্নে তা দিতে জলের মতো অর্থ খরচ করা হয়েছে বছরের পর বছর।
তবে, লিওনেল মেসি, কিলিয়ান এমবাপ্পে, নেইমাররাও যখন পারলেন না, ভেবে নেওয়া হয়েছিল পিএসজির ইউরোপ জয়ের স্বপ্ন বুঝি পূরণ হওয়ার নয়!
অলক্ষ্যে বসে ভাগ্য-বিধাতা বুঝি ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিলেন এতদিন!
‘হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা’র মতো হয়ে আসা কোচ লুইস এনরিকে এসে অবশেষে আইফেল টাওয়ার আলোকিত করলেন চারবার!
আসলে প্যারিস শহর আগেই ঠিক করে রেখেছিল, মিউনিখের আলিয়াঞ্জ আরিনায় চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে পিএসজি যতগুলো গোল করবে, ততবার আইফেল টাওয়ার আলোকিত করা হবে।
মিউনিখের আলিয়াঞ্জ আরিনার ফাইনালে পিএসজি পেয়েছে ৫-০ গোলের জয়।
এর মধ্য দিয়ে এই প্রতিযোগিতায় নিজেদের ইতিহাসে দ্বিতীয় ফাইনালে গিয়ে প্রথমবারের মত শিরোপা উঁচিয়ে ধরল লিগ ওয়ানের ক্লাবটি।
এই রাতকে ফরাসি ক্লাবটির ইতিহাসে ‘গ্রেটেস্ট নাইট’ না হয়ে পারে-ই না!
শুধু শিরোপা জয়ের জন্যই নয় বরং পিএসজি যেভাবে খেলেছে, সেজন্যও এই রাতটি ক্লাবটির সমর্থকদের হৃদয়ে গাঁথা থাকবে।
ইউরোপসেরার এই প্রতিযোগিতার ইতিহাসে এর আগে ফাইনালে কোনো দলই ৫ গোল ব্যবধানে জিততে পারেনি। এনরিকের পিএসজি প্রথম দল হিসেবে এত বেশি গোল ব্যবধানে জয়ের পাশাপাশি এ মৌসুমে ‘ত্রিমুকুট’ও জিতে নিলো।
ভাগ্যের কী লীলা, পিএসজির আক্রমণের পর আক্রমণে বিবশ হয়ে পড়া ইন্টারেরও ‘ট্রেবল’ জয়ের সুযোগ ছিল। কিন্তু রাতটি আসলে তাঁদের ছিল না।
নিজের নয় বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমানো মেয়ে জানার জন্য এবারের ইউরোপসেরার মুকুট জিততে চেয়েছিলেন পিএসজি কোচ এনরিকে।
সৃষ্টিকর্তা শুধু তাঁর মনের এই ইচ্ছে-ই পূরণ করেননি, দ্বিতীয়বারের মতো মাথায় তুলে দিলেন ‘ত্রিমুকুট’ও। রাতটি তাই শুধু পিএসজির না হয়ে পারে-ই না!
পিএসজির ক্ষুরধার আক্রমণের সামনে ইন্টারের ডিফেন্স একেবারে বালির বাঁধের মতো ধ্বসে পড়েছে।
২০ মিনিটের মধ্যে ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়ার পর প্রথমার্ধে আর গোল হজম করেনি ইন্টার।
কিন্তু বিরতির পর ৬৩, ৭৩ ও ৮৬ মিনিটে আরও তিন গোল হজম করার পথে সিমোনে ইনজাঘির দলকে দেখে মনে হয়েছে ইউরোপ সেরার দৌড়ের তারা হাল ছেড়ে দিয়েছে।
হতাশ ছিলেন ইনজাঘি নিজেও। স্যুট পরে ডাগ আউটে দাঁড়ানো এই ইতালিয়ান কোচ প্রথম দুটি গোল হজমের পর গায়ের কোট খুলে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। মাঠে শিষ্যরা যে দাঁড়াতেই পারছিলেন না! চতুর্থ গোল হজমের পর নিশ্চুপ হয়ে যান ইন্টারের এই কোচ।
১২ মিনিটে পিএসজি রাইটব্যাক আশরাফ হাকিমির গোলের ৮ মিনিট পর দ্বিতীয় গোলটি ফরোয়ার্ড দেজিরে দুয়ের। বিরতির পর ৬৩ মিনিটে দুয়ে তৃতীয় গোলটি করার পর ম্যাচে শুধু আনুষ্ঠানিকতাই বাকি ছিল।
৭৩ মিনিটে খিচা কাভারেস্কাইয়া ও ৮৬ মিনিটে মাইয়ুলুর গোল পিএসজির পক্ষ থেকে যেন সেই আনুষ্ঠানিকতারই শেষ উপহার!
বার্সেলোনার হয়ে ২০১৫ সালে ট্রেবল জয়ের সময় জানা মাঠেই ছিল তাঁর সঙ্গে।
মেয়ে হারিয়ে কয়েকটি বছর বিষাদে ডুবে থাকার পর থেকে এনরিকের জীবনে এটাই কি সেরা রাত?
ধারাভাষ্যকারেরা সে কথাই বলছিলেন। কারণ আজকের মতো করে তাঁকে নিকট অতীতে এভাবে আনন্দে ভেসে যেতে দেখা যায়নি। ধারাভাষ্যকারেরা অবশ্য ম্যাচের শুরুতে আরও একটি কথা বলেছেন।
আলিয়াঞ্জ আরিনায় টানেল দিয়ে দুই দল মাঠে ঢোকার সময় ধারাভাষ্যকারো বলছিলেন,
‘ইটস অ্যা ফাইট বিটুইন মেন ভার্সেস বয়েজ’।
পিএসজির একাদশের গড় বয়স পঁচিশের একটু বেশি। ইন্টারের ত্রিশের ওপাশে। কিন্তু পিএসজির অল্প বয়সী ‘বয়েজ’রাই খেলেছেন নির্মম মানসিকতায় বুদ্ধিমত্তার ক্ষুরধার ব্যবহারে।
সেমিফাইনাল থেকে ফাইনাল পর্যন্ত ম্যাচের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইন্টারের পক্ষ থেকে তাদের প্রতীক বিশাল এক নীল সাপের ছবি বার বার পোস্ট করা হয়েছে।
এবার ফাইনালের আগেও যেমন পিএসজির পোশাকে এক ‘নাইট’ এর ছবি বানিয়ে তাঁকে সেই সাপের সামনে খুব ছোট্ট করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
কিন্তু শেষ বাঁশি বাজার পর বোঝা গেল, সাপটি আসলে বিষহীন ঢোঁড়া, রক্তমাংসের নাইটরাই সত্যিকারের বীরপুরুষ।
এদিকে গ্যালারি থেকে মাঠের সব দৃশ্য দেখে আজ মিটিমিটি হেসেছেন পিএসজির কাতারি মালিক নাসের আল খেলাইফি। শেষ বাঁশি বাজার পর শিশুর মতো হাসি ফুটেছে তাঁর মুখে।
প্রথমার্ধে গোলের সুযোগ তৈরি হয়েছিল মাত্র ২টি, যেখানে পিএসজির ১৩টি! প্রথমার্ধে ফরাসি ক্লাবটি শটও নিয়েছে ১৩টি। পোস্টে থাকা ৫টি শটের মধ্যে গোল হয়েছে দুটি, বাকি তিনটি সেভ ইন্টার গোলকিপার ইয়ান সমারের।
সিবিএস স্পোর্টসের বিশ্লেষণে ফরাসি কিংবদন্তি থিয়েরি অঁরি বলেছেন, পিএসজি এ ম্যাচে সাত থেকে আটটি গোল করতে পারত।
১৯৬২ সালে ইউসোবিওর পর প্রথম ‘টিনএজ’ হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে জোড়া গোল করলেন দুয়ে। সেটাও এমন এক স্টেডিয়ামে যেখানে ইউরোপের কুলীন এ প্রতিযোগিতার ফাইনাল নতুন চ্যাম্পিয়ন পেয়ে আসছে।
পিএসজির ক্ষেত্রেও ধারাটা বজায় থাকল অন্যরকম এক প্রতিশোধের স্বাদ উপহার দিয়ে।
২০২০ সালে লিসবনের ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হেরেছিল পিএসজি। এবার সেই বায়ার্নের ঘরের মাঠ থেকেই জিতল শিরোপা।
হাকিমির কাছে এই রাত তাই ঐতিহাসিক,
‘আমরা ইতিহাস গড়েছি। এই ক্লাবের ইতিহাসে আমাদের নাম লিখিয়েছি। অনেকদিন ধরেই ক্লাবের এটা প্রাপ্য ছিল। আমরা খুব খুশি।’
হাকিমিরা পিএসজিকে সেই প্রাপ্য বুঝিয়ে দিলেন ইউরোপসেরার ক্লাব প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে একপেশে ফাইনাল উপহার দিয়ে।
পিএসজি সমর্থকেরা হয়তো চাইবেন, এই একপেশে রাত যেন কখনো না ফুরায়! অন্তত তাঁদের মনের ঘড়িতে এই রাতে কখনো ভোরের ঘণ্টা বাজবে না।